রমজানের সুষম ইফতারের মেনু সাজানো


ইফতার

ইফতার শব্দটি আরবি إفطار‎‎ শব্দ; এর অর্থ ভঙ্গ করা। রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সারাদিন রোযা রাখার পর সূর্যাস্তের খাবার বা পানীয় গ্রহন করে রোজা শেষ/ভঙ্গ/সমাপ্ত করে। এই খাবার গ্রহন করাকে ইসলামের ভাষায় ইফতার বলে। রমজান মাসে সকল মুসল্লি এক সাথে ইফতার গ্রহণ করেন। খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নত। তবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গায় পানি দিয়ে, আবার কিছু কিছু স্থানে ভেজা চাল দ্বার ইফতার করে। তবে সারা দিন রোজা পালন করে পুষ্টিকর খাবার না খেলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশের সকল স্থানে রমজান মাসে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজারে/রাস্তার মোড়ে ইফতার বিক্রি করা হয়। এ সকল দোকানে বা হোটেলে ইফতারের খাবার হিসেবে পিয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, হালিম, জিলাপি বিক্রি করা হয়।


ইফতারের সুষম খাবার 

পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালন করা একটি ফরজ ইবাদত। প্রতি বছর মুসলিম দেশগুলোতে রমজান মাসে সবাই রোজা রাখার জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহন করে। তারা দৈনন্দিন কার্যবলীর সময়সূচির মধ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। রমজান মাসে বিকাল বেলা থেকে ইফতারের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাবারের আয়োজন করে থাকে। এই সময় বাসাবাড়িতে নানা রকম সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার তৈরি করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রমজান মাসের ইফতার মেন্যুতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সময়ে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন তাই সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারির মেন্যুতে রাখে নানা প্রকার পুষ্টিকর খাবার। তাছাড়া মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন ‌‌‍‍”তোমরা রমজান মাসে খাবারের মধ্য হতে সর্বোত্তম খাও ও পান কর ‍‍‍”।  

ইফতার খাবার হওয়া উচিত এমন যার ভিতরে সুষম উপাদানের মিশ্রণ থাকে। সারাদিন রোজা পালন করে না খেয়ে থাকার কারণে  দিন শেষে রক্তে গ্লুকোজ কমে যায়। গ্লুকোজকে বলা হয় মস্তিষ্কের খাদ্য। এজন্য ইফতারের মেন্যুতে এমন আইটেম রাখা উচিৎ যা তারাতারি রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করতে পারে।

একজন রোজাদারের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ইফতারে কি খাবেন তা নির্ভর করে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের উপর। সবসময় দোকানের তৈরি ইফতার খাবার না খাওয়াই ভালো। রোজাদার সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য ইফতারে খেজুর বা খুরমা, ঘরে বানানো বিশুদ্ধ শরবত, কচি শশা/খিরা, ফরমালিনমুক্ত তাজা মৌসুমী ফল, ভেজানো চিড়া খাবার খাওয়া উচিৎ।

এছাড়া বাসায় বিশুদ্ধ তেলে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে ভাজা পেয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, জিলাপি এবং বুট ও মুড়ি খাওয়া যেতে পারে। অনেকেই ইফতার রেসিপির ভিন্নতা আনার জন্য  নুডুলস, সেমাই, তেহারি, হালিম ইত্যাদি রান্না করেন। ইফতারের খাবার দোকান থেকে ক্রয় করে খাবার চেয়ে বাসায় রান্না করে নেয়াই উত্তম। তবে নিশ্চিত হয়ে ভাল হোটেল বা রেস্তরার স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার ক্রয় করে খাওয়া যেতে পারে। 

ফল অথবা ফলের রসের জুস কিংবা শরবত শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারে; পাশাপাশি ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের সরবরাহ করে। তবে এতে এমন কিছু উপাদান থাকা জরুরি যা হজম হতে সময় নেবে। শরীরে হজম হতে সময় নেয় এমন খাবার হলো চিড়া, ভাত, রুটি, মুড়ি, আলুর চপ, তেহারি ইত্যাদি। তারাবির নামাজ পরে নিয়মিত ভাত, মাছ, মুরগী বা মাংস, ডাল ও সবজি জাতীয় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অভ্যাস করা উচিৎ।


ইফতারের ঝুঁকিপূর্ণ খাবার

যদিও বর্তমানে সবাই স্বাস্থ্য সচেতন কিন্তু গ্রামের মানুষ এখনও স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন চিন্তা করে না। তারা যে সকল মুখরোচক খাবার খায় সেগুলো স্বাস্থ্যগুণ নিয়ে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন।  পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে- বর্তমানে দোকানগুলোতে ইফতার ও সেহরির যেসব খাবার বিক্রয় হচ্ছে এগুলোর পরিমাণ ও গুণগত মান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। 

গ্রামের মানুষের এখনও রাস্তার ইফতারি আইটেম দিয়ে ইফতার করার প্রবণতা রয়েছে।  এই প্রবণতাকে কেন্দ্র করে রাস্তার মোড়ে বসে রমরমা ইফতারের বাজার। এখানে পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে বসে অস্বাস্থ্যকর ইফতারের আইটেম বিক্রি করার জন্য। এই দোকানগুলো মধ্যে কমন মেন্যু হলোঃ খোলা খেজুর, পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, ছোলা, মুড়ি, ডাল বড়া, সবজি বড়া, হালিম, বিভিন্ন ধরণের কাবাব, জিলাপি ইত্যাদি। এর পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, বিভিন্ন রং মিশ্রিত শরবত। চিকেন ফ্রাই, বারবিকিউ, বিরিয়ানি, তেহারি ও ভুনা খিচুড়ি থাকবেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সকল মুখরোচক ও আকর্ষনীয় খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না/তৈরী করা হয়েছে কিনা? প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব- না; এগুলো মোটেই স্বাস্থ্যস্মত না। প্রায় সকল প্রকার মুখরোচক খাবার রান্নায় ব্যবহৃত হয় ভেজাল তেল, বেসন ও কৃত্রিম রং। সবচেয়ে বড় কথা একই তেল একাধিক বার ব্যবহারের ফলে তেলের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরি। এটা হয়ত অনেকেই জানতেন না বা জানলেও পাত্তা দিতেন না বা বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস না হলে বড় বড় মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের সাইটে দেখতে পারেন।

তেল একাধিক বার ব্যবহারের ফলে তেলের ভিতরে পলি নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়। এই পদার্থে রয়েছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বেনজা পাইরিন নামক বিষাক্ত পদার্থ। তাছাড়া অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ইফতার তৈরির ফলে ইফতার বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা দূষিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে; যার ফলে পেট ব্যাথা হয়ে থাকে।

বর্তমানে যুগে ফল সংরক্ষণের জন্য ফরমালিনের যে পরিমাণ ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ভেজাল মুক্ত টাটকা ফল পাওয়া আশা করাই কঠিন। তবে এক ঘণ্টা  ভিনেগার মিশ্রিত পানিতে ফল ডুবিয়ে রাখলে কিছুটা ফরমালিন মুক্ত হয়। আবার রাস্তার পাশের দোকান গুলোতে যে রকমারি শরবত বিক্রয় করা হয় সেগুলো বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি করা হয় কিনা তাও প্রশ্নবিদ্ধ।


রমজানে পানি শূন্যতা রোধের উপায়

রমজানে ১২-১৫ ঘন্টা পানি না পান করে থাকতে হয়। এতে শরীরে প্রচুর পরিমাণে পানি শূণ্যতা দেখা দেয়। এজন্য ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করা উচিৎ। পানিতে ওরাল স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়া ভাল তবে টেস্টি স্যালাইন কখনও খাবেন না। 

ইফতারের সময় জুস, লেবু পানি, টকদই,  দুধ, বেলের সরবত, ইসবগুলের ভুসি ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর পানীয় তৈরী করা যায়। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য  চিনিমুক্ত (চিনির বিকল্প) সরবত বা ডাবের পানি পান করতে পারেন।

ইফতারে দই-কলা দিয়ে চিড়া, শসার রাইতা ও নানা রকমের ফল পানি শূন্যতা রোধ করবে বলে আশা করা যায়। দুধ ও মুড়ি, নরম খিচুড়িও ভালো খাবার। 


গরমে সুষম ইফতার

আমাদের সমাজের ঐতিহ্যবাহী ইফতার আইটেম পেয়াজু, বেগুনি, কাটলেট, চপ, কাবাব, জিলাপি, তেহারি ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর ক্যালরি, কিন্তু গরমে এই খাবার গুলো অস্বস্তিকর হতে পারে। ইফতারের খাবারে তেল কমানোর উপায় হল কাঁচা ছোলা বা সেদ্ধ ছোলার সঙ্গে শসা, পেঁয়াজ, টমেটো, আদা কুচি, পুদিনা মিশিয়ে দিয়ে সুষম খাবার তৈরি করা। আবার চটপটিও একটি তেলবিহীন খাবার। ইফতারের প্লেটে তেল জাতীয় খাবার হালকা রাখুন; সবগুলো তেলমুক্ত খাবার রাখবেন না। দু-একটি তেলে ভাজা খাবার রাখুন, তবে সেগুলো যেন ভাল তেলে ভাজা ও হালকা তেলযুক্ত হয়।


ইফতারের সময় ফলমূল

রমজান মাসে শাক-সবজি খাবার তেমন সময় পাওয়া যায়না। এই শাক-সবজির অভাব পূরণ করতে তাজা ফল বেশি খাওয়া ভালো। ফল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য কম হয়; কোষ্ঠকাঠিন্য দুর হয় বললেই চলে।  ফল খেলে আমাদের শরীরের আঁশের চাহিদা পূরণ হয়, প্রচুর পটাশিয়াম, খনিজ ও ভিটামিন এর যোগান পাওয়া যায়। ইফতারের আদর্শ ফল হল খেজুর। এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার আয়রন, শর্করা ও ক্যালসিয়াম। কিন্ত এতে ক্যালরি প্রচুর থাকে তাই বেশি খাওয়ায় ক্ষতি হতে পারে; ইফতারের টেবিলে দুই-তিনটির বেশি খেজুর না রাখা ভাল। এর পাশাপাশি পাকা কলা, কমলা লেবু, মালটা, পাকা পেপে, বাংগি, সফেদা, তরমুজ, ডাবের পানি ও পেয়ারা খাওয়া প্রচুর উপকারি। 


একটি আদর্শ ইফতারের প্লেট

১। দুটো খেজুর।

২। শরবত বা ডাবের পানি। 

৩। হালকা তেলে ভাজা /সেদ্ধ/কাঁচা ছোলা।

৪। অল্প স্বাস্থ্যকর পেঁয়াজু/আলুর চপ/পাকোড়া/কাবাব (যে কোন দুইটি)

৫। মেন্যুতে হালিম থাকলে বেসন বা ডালের তৈরি খাবার না রাখা।

৬। পরিমাণমত ফল (মাল্টা, পেয়ারা, পাকা কলা, তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস)

৭।  শসার রায়তা অথবা দুই চামচ টকদই।

৮।  মিষ্টির জন্য হালুয়া, পুডিং, স্বাস্থ্যসম্মত জিলাপি, মিহি দানা, ফিরনি, গোলাপ জাম। (যেকোনো একটি)

নবীনতর পূর্বতন