ইবলিশ শয়তান ও জিন জাতির আসল ইতিহাস


ইবলিশ শয়তান ও জিন পরিচয়ঃ

জিনদের পঞ্চমতম বাদশা হামুসের বাদশা খবিসের ঔরোসে এবং তার কন্যা নিবলিসের গর্ভে ইবলিশ শয়তান এর জন্ম। খবিস ছিল সিংহের মতো শক্তিশালী। আর স্বভাব ছিল বাঘের মত। নিবলিস ছিল ভীষন ধ্রত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ইবলিস ছিল অসাধারণ প্রতিভাবান, খুবই সুদর্শন, সাহসী, শক্তিশালী এবং এক ঘুয়ে। ইবলিস শয়তানের গ্রীহ শিক্ষক ছিল সারবৌক।

তার ছিল ছাব্বিশ হাজার বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। তিনি  ইবলিসের মত মেধাবী ছাত্র তার শিক্ষা জীবনে কোথাও পায়নি। তাই সে খবিস কে বলেছিল তার ছেলের প্রতি খেয়াল রাখতে।

তার ছেলে জীবনে বিরাট কিছু একটা হবে। সময়ের বিবর্তনে জীনদের নোংরা আচরণে অসন্তুষ্ট হয়। তখন মহান আল্লাহ পাক হামুসের বংশ ধ্বংস করার নির্দেশ দান করেন। ফেরেশতারা আল্লাহর কথা মত তাই করেন। তবে ইবলিশের দেহবর্ণ এবং জ্ঞানের গভীরতা দেখে ফেরেশতা তাকে রেখে দেয়।

ইবলিসের ইবাদত ও বিভিন্ন সম্মাননাঃ

ইবলিশ শয়তান এর আচরণে ফেরেশতাদের মন জয় করে। সেজন্য ফেরেস্তারা ইবলিস কে খাসিন নামক সনদ দিয়েছিলেন, যার অর্থ ছিল মহাজ্ঞানী । এরপর ফেরেস্তাগন তাকে আসমানে তুলে নিলেন। দ্বিতীয় আসমানে ইবলিসের ইবাদত-বন্দেগীতে একাগ্রতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে আবেদ সনদ দান করলেন।

এরপর তার উন্নতি ঘটে দ্বিতীয় আসমানে। প্রতি আসমানে ইবলিস এক হাজার বছর ইবাদত করেছিল। এভাবে সে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম আসমানে পৌঁছায়। এবাদত বন্দেগিতে একাগ্রতা এবং উৎকর্ষের সাথে সাথে সে অলি, সালেহ, মুত্তাকী, খাঁজেরুলাচসহ আরো অনেক সনদ পায়। ইবলিস ফেরেশতাদের ওয়াজ-নসীহত করত।

ফেরেশতাদের গণতান্ত্রিক আবেদনে আল্লাহ পাক ইবলিস কে আরশে মোয়াল্লায় তুলে নেয়। ইয়াকুত পাথর এর সূউচ্চ মেম্বারে বসে এবাদত-বন্দেগি করত এবং ফেরেশতাদের মাঝে ওয়াজ নসিহত করত। তারপর সে লাভ করে মুয়াল্লিমুল মালাইকা বাস ফেরেশতাদের শিক্ষক নামক খেতাব।

জিন জাতীর বংস বিস্তারঃ

এভাবে  ছয় হাজার বছর কেটে গেল। ইতিপূর্বে পাপী জিনদের ধ্বংস করার সময় কিছু সংখ্যক সচ্চরিত্র জিন পাহাড় পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করে মহান আল্লাহপাকের ইবাদতে মগ্ন থেকে জীবন রক্ষা করেছিল। এতদিনের সব ভালো জ্বীনদের বংশধরদের দ্বারা পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যায়।

এসব জিনদের ভালোভাবে হেদায়েত করার জন্য আল্লাহপাক ইবলিসকে পৃথিবীতে আসার নির্দেশ দান করেন। সে সময় ইবলিশ শয়তান দরখাস্ত করল যে, সারাদিন পৃথিবীতে আল্লাহর নির্দেশে কাজ করবে বটে; তবে রাতে যেন আল্লাহ পাকের আরশে মোয়াল্লায় আল্লাহপাকের ইবাদতের রাত যাপনের অনুমতি দান করেন। আল্লাহ পাক তার দরখাস্ত মঞ্জুর করেন।

ইবলিশের কিছু কাজঃ

ইবলিস জিনদের হেদায়েদ ও আরশে মোয়াল্লায় এবাদত এর পাশাপাশি ফেরেশতাদের ওয়াজ-নসীহত দান করে। তবে কিছুকিছু ফেরেশতা ইবলিসের উপদেশ উপেক্ষা করে তাদের রুচি অনুযায়ী চলতে লাগল। ইবলিস রাগান্বিত হয়ে আল্লাহ্ পাকের নিকট জীনদের ধ্বংস করার জন্য আবেদন করলো।

ইবলিস জিনদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ্ পাকের নিকট আবেদন না করে ধ্বংস করার প্রার্থনা করল। এভাবেই ইবলিস জিন ও ফেরেশতাদের নেতা হয়ে গেল। আসমান ও জমিনে এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে ইবলিস সেজদা করেনি।

লাওহে মাহফুজে ইবলিসের ভ্রমনঃ

ইবলিশ শয়তান এর লাওহে মাহফুজ দর্শনের ইচ্ছা জাগ্রত হল। ইবলিশ আল্লাহর নিকট লাওহে মাহফুজ দেখার দরখাস্ত করলে, মহান রব্বুল আলামীন তার দরখাস্ত মঞ্জুর করল। হযরত মিকাইল আলাইহি সাল্লামের উপর দায়িত্ব পড়ল তাকে লাওহে মাহফুজ ঘুরিয়ে দেখানোর। লাওহে মাহফুজে রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ জিন ও ফেরেশতাদের ভাগ্য লিপি বা কর্মফলের রেজিস্টার।

লাওহে মাহফুজে গিয়ে ইবলিস দেখলো আল্লাহর সৃষ্টির এক দাস বা বান্দা একাধারে ছয় লক্ষ বছর ইবাদত করার পরও আল্লাহর একটি মাত্র আদেশ অমান্য করার অপরাধে অভিশপ্তে রূপান্তরিত হয়ে বেহেশত হতে বিতাড়িত হবে।

আর সেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, লা’নাতুল্লাহি আলাল ইবলিস অর্থাৎ ইবলিশের উপর লানত বর্ষিত হোক। ইবলিশ তখনও জানতো না কে সেই অভিসপ্ত ইবলিশ। এটা দেখে ইবলিশ এক সিজদায় ছয় হাজার বছর কাটিয়ে দেয়।

ইবলিশের অহংকারঃ

আল্লাহর সকল আদেশ নির্দেশ ইবলিশ পালন করতো কিন্তু তার জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্জিত জ্ঞান ইত্যাদি তার মনে অহংকার এর সৃষ্টি করে। সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে থাকে যে, আমি সমস্ত আসমান-জমিনের জিন ও ফেরেশতাদের নেতা।

তাই আল্লাহর সৃষ্টি সকল জীব ফেরেশতা ও জিন থাকে মান্য করবে। সে ভাবতো আল্লাহপাক ও তাঁর কাছে প্রতিযোগিতা হেরে যাবে। তাছাড়া সে ছিল জিন ও ফেরেশতাদের প্রধান শিক্ষাগুরু।

এ কারণে সে ভাবতে লাগল যে কোন সময় আল্লাহপাকের অধীনতা থেকে সে স্বাধীনতা ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখে। ইবলিশ তার জনগণ বা জিন ও ফেরেশতাদের বোঝাতে চাইল সেই সর্বময় ক্ষমতাধারী। জিন ও ফেরেশতাগণ, ইবলিসকে আল্লাহপাকের সার্বিক ক্ষমতাকে স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলল।

তখন সে কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিল। ইবলিসের ধারণা তার প্রতিযোগিতার কাছে আল্লাহর কোনো শাস্তি কার্যকর হবে না।

জিন জাতির বিকাসঃ

আল্লাহ পাক বারবার খারাপ জিনদের সৎ পথে আনার জন্য তাদের মধ্য হতে সৎ এবং ধার্মিক বাদশা নিযুক্ত করেছিলেন। বারবার জিন সম্প্রদায় কালের আবর্তনে ব্যভিচার, হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছিল। জিনদের প্রথম বাদসা চালপলিশ ছত্রিশ হাজার বছর জিনদের উপর বাদশাহী করেছিল।

এরপর বিল্লিকা এবং হামুস বাদশা হয়েছিল। এরা ছিলেন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ কিন্তু জিনরা তাদের মাঝে হানাহানি ও বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বাদশাহ হামুসই ছিলেন জ্বীনদের সর্বশেষ বাদশা। তারই জঘন্য প্রকৃতির ছেলে খবিশ এবং নোংরা চরিত্রের কন্যা নেবলিসের সন্তান হল প্রতিভাবান ইবলিশ শয়তান। 

মানব জাতি সৃষ্টি ও ইবলিসের শয়তান হওয়াঃ

আল্লাহপাক আদম সম্প্রদায় সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আদম (আঃ) কে তৈরি করার জন্য আজরাইল (আঃ) কে মাটির সংগ্রহ করতে বললেন। আজরাইল (আঃ) পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা হতে সংগৃহীত মাটির দ্বারা আদম (আঃ) এর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করলেন। তারপর সেই দেহকে আল্লাহ পাকের আরশের নিচে শুয়ে রাখলেন।

ফেরেশতাগণ শায়িত আদম (আঃ) নিষ্প্রাণ দেহ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল এবং তারা তা ইবলিশকে বলল। ইবলিশ আদম (আঃ) এর দেহ দেখে পরীক্ষা করে আশ্চর্য হল কিন্তু ফেরেশতাদের বুঝতে দিলো না। শুধু ফেরেস্তাদের বললো মানুষ দিয়ে আল্লাহর খেলাফত চলবে না, সুতরাং ভাবার কিছু নেই। এরপর মহান আল্লাহপাক আদম (আঃ) এর শরীরকে নিপুন সৌর্ন্দয্যে উদ্ভাসিত করলেন এবং প্রাণ সঞ্চয় করলেন। ফেরেশতাদের বললেন, আদম কে সেজদা করে সম্মান জানাতে।

সবাই সিজদা করল কিন্তু ইবলিশ সেজদা করতে অস্বীকার করল। সে বলল মরণশীল মাটির তৈরী মানুষ কে সে সিজদা করবে না। তারপর আল্লাহ পাক তাকে আসমান থেকে বের করে দিলেন এবং বললেন কেয়ামত পর্যন্ত ইবলিসের উপর আল্লাহর অভিশাপ থাকবে।

শয়তান হিসেবে ইবলিসের ইচ্ছা ও শক্তিঃ

ইবলিশ কিয়ামত পর্যন্ত তার সাজা মওকুফ রাখার জন্য অনুরোধ করলো অর্থাৎ বেঁচে থাকার প্রার্থনা জানালে আল্লাহ পাক কবুল করলেন। শুধু তাই নয়, তার প্রার্থনা লিস্টে যোগ করল; মুসলমানদের নামাজের সময় তার বাদ্য বাজানোর অধিকার, অশ্লীল গান গাওয়া ও নিত্যের অধিকার এবং মানুষকে ভুল পথে চলার মন্ত্রনা দানের অধিকার।

এইসব দেখে আদম (আঃ) শয়তানের শয়তানী ভয় পেতে শুরু করলে আল্লাহ পাক তাকে অভয় দিয়ে বললেন, তুমি ভয় পেয় না; মানুষকে সৎ পথে চলার এবং শয়তানের ধোকা হতে আত্মরক্ষার জন্য আমি তোমার বংশধরদের বিধি বিধান সম্বলিত কিতাব নাযিল করব এবং নির্দেশিত পথে চলার জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করব। আমার বিধান মত চললে তাদের বিপথগামী হওয়া বা অভিসপ্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

তারা ইবলিশের এর ধোকা হতে রক্ষা পাবে। মহান আল্লাহপাক বেহেশত হতে ইবলিশ শয়তান কে বিতারিত করলেন। তবে মানব সমাজে ইবলিশের বিচরণ সর্বত্র। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করে তা হল; লোভ, উত্তেজক গান, বাজনা, নাচ, চট্টলবাক্যলা, ক্ষমতার মোহ, নারী দেহ, সম্পদের লোভ, লালসা, নেশাদ্রব্য, অহংকার, অভিনয়, মিথ্যাচার, পরহিংসা, জিঘাংসা ইত্যাদি। শয়তান মানুষকে পরনিন্দায় উৎসাহিত করে।

অন্যের অকল্যাণে একজনকে আরেকজন দ্বারা প্রভাবিত করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব কে ফুলিয়ে ফাপিয়ে মহান আল্লাহ কাছাকাছি নিতে উৎসাহী করে। পার্থিব সুখ ও যৌন উল্লাসী করে রাখে মানুষকে। এসকল ধোকা হতে যারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে তারাই আল্লাহর রহমতের ভাগীদার হয়।

পরকালের সুখ, বেহেশতের নিশ্চয়তা শুধু তাদের রয়েছে যারা আল্লাহর বিধানকে তাদের জীবনাচারে প্রতিফলিত করে। আর ইবলিশের ও তাদের উত্তরাধিকারীর স্থায়ী সম্পত্তি হল জাহান্নাম। জাহান্নামের সংসদের সংসদীয় নেতা হবে খবিশের ছেলে ইবলিশ।

শেষ কথাঃ

ইবলিসের জীবন কাহিনী মানুষের জন্য চাক্ষুষ উদাহরণ। যার বিবেক আছে সেই বুঝতে পারে। যেমন ইবলিসের একটি অবাধ্যতা কারণে চয় লক্ষ বছরের ইবাদত করেও তার ফলাফল হয় জাহান্নাম। অপরের ক্ষতি চিন্তা ও চেষ্টা একজন মানুষকে কোন নরক নিয়ে যেতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল ইবলিশ।

ইবলিসের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আমরা যেন খাঁটি মুসলমান ও মুমিন হতে পারি আল্লাহ আমাদের কবুল করে নিন। আমীন।

নবীনতর পূর্বতন