মাযহাব অর্থ কি? মাযহাব কয়টি ও কোনটি সঠিক? প্রমাণসহ

মাযহাব হলো ইসলামী ফিকহ বা ব্যবহার শাস্ত্রের ভিতরের একটি চর্চা কেন্দ্র। নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এর মৃত্যুর পর আনুমানিক প্রায় দেড়শত বছরের মধ্যে অসংখ্য মাযহাবের উৎপত্তি হয়।

মাযহাব অর্থ কি?

চলার পথকেই মাযহাব বলে। কোরআন ও সুন্নাহর প্রদর্শিত, নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) অণুগামী ও সৎ কর্মশীল ব্যক্তি বর্গের বাছাই করা পথের নামই হল মাযহাব। ভিন্ন অর্থে একেই সিরাতাল মুস্তাকিম ও সরল পথ বলা হয়। সুতরাং মাযহাব কোন নতুন ধর্ম, মতবাদ বা কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব মতবাদের নাম নয়। বরং মাযহাব হল কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কেয়াসের আলোকে বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যার প্রদত্ত সমাধান। যার বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ তাদের মতবাদ প্রদান করেছেন। মাজহাব হল কুরআন ও হাদিসের অস্পষ্ট আয়াত ও হাদীস গুলোর  ব্যাখ্যা মাত্র।

ইসলামে মাযহাব কয়টি

অনেকেই হয়ত জানে না ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত মাযহাব কয় টি? ইসলামে সর্বজন স্বীকৃত মাজহাব চারজন। এই চারজন মাযহাবই ইসলামের মুল ৪ টি ভিত্তি তথা কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে প্রণীত । এই ৪ টি মাযহাবের ব্যাপারে নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এরও সমর্থন ছিল। যা আমরা হাদিসের মাধ্যমে জানতে পারি। তাহলে মাযহাব অনুসারণ করার মানেই হল রাসুলের কথা মানা। 

অনেকে বলতে পারেন যে, নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) কুরআন ও হাদিস মানতে বলেছেন তাহলে মাযহাব মানার দরকার কি? কুরআন ও হাদিসের কথা অবশ্যই ঠিক । কিন্তু কুরআন ও হাদিসের প্রত্যক্ষ –পরোক্ষ, সুস্পষ্ট –অস্পষ্ট ও পরস্পর বিরোধপূর্ণ সমস্যাযুক্ত বিষয়ের যথাযথ সমাধান বের করে তা অনুসরণ করা সম্ভব নয়। বরং এ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তি বর্গের দেওয়া সমাধান মেনে চলাই শ্রেয়।

মাযহাব নিয়ে বিতর্ক

ভারত উপমহাদেশের মুসলিম ভায়েরা রুটি-রুজির সন্ধানে যখন সঊদী আরব আগমণ করেন, তখন এখানে তারা ইবাদত বন্দেগীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত নিয়মের অনেক ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেন। তম্মধ্যে বিতর নামায অন্যতম। এ নামায আমাদের দেশে সাধারণতঃ যে নিয়মে পড়া হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত নিয়ম তারা সউদি আরবে দেখতে পান।

বিশেষত রমজান মাসে যখন জামাতের সাথে বিতর নামায পড়া হয়। তখন তারা হতবাক, পেরেশান ও মতবাদী হয়ে নিজ দেশের ইমাম ও মুফতী সাহেবানকে পত্র মারফত কিংবা ফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে, এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি? দেশের ইমাম ও মুফতী সাহেবান তাদের নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী জবাব পাঠিয়ে দেন। তাদের কারো মতে তাদের সাথে নামাজ পড়তে বলে আবার কেউ কেউ আলাদা নামাজ আদায় করতে বলে।

ইসলামে দলের সৃষ্টি

সে সময় দেখা গেল, বিতর শুরু হওয়ার সময় বিরাট এক দল মুসলিম জামাত থেকে বের হয়ে যায়। তাদের কেউ মসজিদে বিতর নামায আদায় করত আবার কেউ নিজ ঘরে গিয়ে বিতর নামায আদায় করে থাকেন।

মাযহাব নিয়ে বিতর্ক না করে, আমি কিছু কিছু আলেমের মতবাদ ও কুরআন হাদিসের আলোকে তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফলে সত্যানুসন্ধানী ও নবী প্রেমী লোকেরা সত্য গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী নিজেদের আমলকে শুধরে নেন।

আমার জানা মতে এরকম লোকের সংখ্যা অগণিত। যারা এক্ষেত্রে নিজেদের আমলকে ছহীহ সুন্নাত মোতাবেক বিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। (আল্লাহ তাদেরকে আরো তাওফীক দিন।) উপরোক্ত কারণে এবং সত্যানুসন্ধানী ভাইদের বার বার অনুরোধ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এ বিষয়ে দলীল ভিত্তিক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করতে।

আল্লাহ আমাদেরকে প্রিয় হাবীব নবী মুহাম্মাদ (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এর সুন্নাতের খেদমতে অংশ নিয়ে রোজ ক্বিয়ামতে তাঁর শাফায়াত নসীব করো। এই লেখাটি পড়ার পূর্বে সম্মানিত পাঠক-পাঠিকার নিকট আমার নিবেদন, আমাদের সকলের উচিত হচ্ছে সার্বক্ষণিক নিম্নলিখিত আয়াত ও হাদীছটি মানস্পটে রাখা।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে মাযহাব

মহান আল্লাহ বলেন, مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّھُ وَرَسُولُھُ أَمْرًا أَنْ یَكُونَ لَھُمْ الْخِیَرَةُ مِنْ أَمْرِھِمْ وَمَنْ یَعْصِ اللَّھَ وَرَسُولَھُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالا مُبِینًا “আলাহ্ এবং তাঁর রাসূল কোন আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোন অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করবে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।” (সুরা আহযাব- আয়াত ৩৬)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “আমার উম্মতের সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে ব্যক্তি জান্নাতে যেতে চায় না সে ব্যতিত। তাঁরা বললেন, কে এমন আছে জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই জান্নাতে যেতে অস্বীকার করবে।” (বুখারি- হাদিস ৬৭৩৭)

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছটি যে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত জীবনের চলমান পথে স্মরণ রাখবে তার জন্য ইসলামের যাবতীয় বিধি বিধান মান্য করা সহজসাধ্য হবে। এ জন্যই আমাদের পূর্বসূরী মহামান্য ইমামগণ হাদীস সম্পর্কে যে অমূল্য কথা বলে গেছেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) প্রেমীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

চারজন মাযহাবের মতবাদ

যেমনঃ ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন, “হাদীস বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হলে সেটাই আমার মাযহাব বা পথ।” [মৃত্যু ১৫০ হিজরি]

ইমাম মালেক (র) বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির কথা গ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কিন্তু শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এর সবকিছুই গ্রহণযোগ্য।” [মৃত্যু ১৭৯ হিজরি]

ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, “আমি যা কিছু বলেছি তার বিরুদ্ধে নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) থেকে সহীহ সূত্রে কোন হাদীস এসে গেলে নবী (ছালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এর হাদীসই হবে অগ্রগণ্য বা প্রথম প্রাধাণ্য, অতএব তোমরা আমএক অন্ধানুকরণ কর না।” [মৃত্যু ২০৪ হিজরি]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (র) বলেন, “তুমি আমার তাকলিদ বা অন্ধানুসরন করো না, মালেক, শাফি, আওযায়ী, ছওরীসহ কারো তাকলিদ বা অন্ধানুকরণ করো না। বরং যেখান থেকে সমাধান গ্রহণ করেছেন সেখান থেকেই গ্রহণ কর।” [মৃত্যু ২৪১ হিজরি]

মাযহাব নিয়ে তর্কে লিপ্ত না হওয়া

সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি আমার অনুরোধ, মাযহাবী গোঁড়ামী পরিহার করে আসুন আমরা একনিষ্ঠভাবে কুরআন-সুন্নাহ্ও সালাফে সালেহীনের নীতির অনুসরণ করি। পাস্পারিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কুরআন-সুন্নাহ্র ছায়াতলে সমবেত হই।

গড়ে তুলি ঐক্য সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে অনন্য দৃষ্টান্ত। বইটি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি হাদীছের রেফারেন্স উলে­খ করে তার নম্বর দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ছাপায় বিভিন্ন নম্বর থাকতে পারে, ফলে পাঠক তাতে বিভ্রান্ত হতে পারেন, তাই প্রতিটি হাদীছের অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ উলে­খ করে দেয়া হয়েছে যাতে করে মিলিয়ে নেয়া সহজ হয়।

আর সাধ্যানুযায়ী সবগুলো হাদীছ ছহীহ বিশুদ্ধই নির্বাচন করা হয়েছে। মাযহাবী গোঁড়ামী মুক্ত হয়ে নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও মুহাক্কেক আলেমদের উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। এই জন্য সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি আবারো সনির্বন্ধ নিবেদন, আপনাদের দৃষ্টিতে কোন ভুল-ত্রটি পরিলক্ষিত হলে তা ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।

সমাপনী

আমার লেখায় লেখার কোথাও ভুল আছে বা সংশোধন করার প্রয়োজন মনে করলে কমেন্ট সেকশনে প্রমাণ-পঞ্জি ও রেফারেন্সসহ সংশোধনের পরামর্শ দিবেন, উহা ধন্যবাদসহ সাদরে গ্রহণ করা হবে। হে আল্লাহ এই বক্তব্যের সাথে জড়িত সকলকে সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত করো। ক্বিয়ামতের মাঠে নবীর পবিত্র হাত থেকে হাওযে কাউছারের পানি পান ও তাঁর শাফায়াত লাভে ধন্য করো। আমীন

নবীনতর পূর্বতন